শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:১৯ পূর্বাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
দৈনন্দিন জীবনে মানুষ অহেতুক মিথ্যা বলছেন অনেকটা নির্বিকার ভঙ্গিতে। আরও ভয়ংকর কথা হলো, আশপাশের ছেলে-বুড়ো তার মিথ্যা শুনছেন এবং তার দিকে ঘৃণাভরে তাকাচ্ছেন। মোবাইলে কথা বলার সময় দেখা যায় অনেকে অহেতুক মিথ্যা বলছেন। বাসে আছেন এক জায়গায়, কিন্তু বলছেন অন্য জায়গার কথা। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, অফিসের সহকর্মী কিংবা স্ত্রী-সন্তানের কাছে ধোঁকা দিয়ে জনারণ্যে অসত্য বলছেন। অথচ তার ভেতরে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তিনি যে একটি অন্যায় কাজ করছেন, তা তিনি চিন্তাও করছেন না। এভাবে রোজকার জীবনে এমন অনেক মিথ্যা কথা বলা হয়, যার কোনো প্রয়োজন নেই। ভাবখানা এমন, অহেতুক এমন মিথ্যা যেন দোষের কিছু নয়। অথচ মিথ্যা তো মিথ্যাই। ঠাট্টাচ্ছলে কিংবা লোক হাসানোর জন্যও মিথ্যা বলা গোনাহের কারণ। মিথ্যাবাদীর কবলে পড়ে সমাজের নিরীহ মানুষ প্রতারিত হন। ইসলামি স্কলারদের মতে, মিথ্যার প্রভাবে মিথ্যাবাদী ক্রমশ মানসিক শক্তি ও সৎসাহস হারিয়ে ফেলেন। তখন তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। তিনি যেকোনো অন্যায়-অপরাধ ও পাপাচারে জড়িয়ে যেতে পারেন। পবিত্র ধর্ম ইসলামে সর্বদা সত্য বলা এবং মিথ্যা বর্জনের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। মিথ্যার নিন্দা করা হয়েছে বহু আয়াত এবং হাদিসে। বিভিন্নভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে মিথ্যা বলতে। উৎসাহিত করা হয়েছে সত্য উচ্চারণে। মহান রব ইরশাদ করেন, ‘সেদিন ধ্বংস মিথ্যাবাদীদের (সত্য তথা ইসলাম অস্বীকারকারীদের) জন্য।’ সুরা আল মুতাফফিফিন : ১০
এক হাদিসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি সেই ব্যক্তির জন্য একটি ঘর জান্নাতের মাঝামাঝিতে নিয়ে দেওয়ার জন্য জিম্মাদার, যে মিথ্যা পরিহার করে; এমনকি হাসি-ঠাট্টার ছলেও।’ সুনানে আবু দাউদ : ৪৮০০
মিথ্যা বলা সব পাপাচারের মূল। যিনি মিথ্যাকে বর্জন করেন, তিনি কোনোরূপ পাপ করতে পারেন না। মিথ্যা সব ধরনের অপরাধে উৎসাহ-প্রশ্রয় দেয়। মিথ্যা বলা মুনাফিকের লক্ষণ। মিথ্যা বলে বেচা-কেনাকারীর সঙ্গে বিচার দিবসে দয়াময় আল্লাহ কথা বলবেন না। হাসি-রসিকতা কিংবা স্বাভাবিক অবস্থায়, মিথ্যা সর্বাবস্থায় হারাম ও অবৈধ কাজ। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) মিথ্যা বলা কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা আল্লাহর নিদর্শনে বিশ্বাস করে না তারা তো কেবল মিথ্যা উদ্ভাবন করে এবং তারাই মিথ্যাবাদী।’ সুরা নাহল : ১০৫
মিথ্যা বলার পরিণাম খুবই ধ্বংসাত্মক। এর জন্য দুনিয়াতে রয়েছে ধ্বংস আর আখেরাতে রয়েছে অপমান ও লাঞ্ছনা। মিথ্যার কারণে অন্তরে কপটতার সৃষ্টি হয়। মিথ্যা পাপাচার ও জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। মিথ্যাবাদীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় না। মিথ্যার কারণে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতেই চেহারা বিবর্ণ ও মলিন হয়ে যায়। বিচার দিবসে মিথ্যাবাদীর চোয়াল চিরে গর্দান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ধ্বংস তার জন্য যে লোক হাসানোর জন্য কথা বলে এবং এতে সে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। ধ্বংস তার জন্য, ধ্বংস তার জন্য।’ সুনানে তিরমিজি
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকবে, সে পাক্কা মুনাফিক এবং যার মধ্যে এর একটা থাকবে, তার মধ্যে মুনাফিকির একটা স্বভাব থাকবে, যে পর্যন্ত না সে তা পরিত্যাগ করবে। ১. যখন তার নিকট কিছু আমানত রাখা হয়, তাতে সে খেয়ানত করে, ২. সে যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে, ৩. যখন ওয়াদা করে, ভঙ্গ করে এবং ৪. যখন কারও সঙ্গে ঝগড়া করে, তখন সে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে।’ মিশকাত : ৫০
হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সত্য গ্রহণ করো। সত্য নেকির সঙ্গে রয়েছে। আর উভয়টি জান্নাতে যাবে। আর মিথ্যা থেকে বেঁচে থাক। মিথ্যা পাপের সঙ্গে রয়েছে। উভয়ই জাহান্নামে যাবে।’ ইবনে হিব্বান : ৪১৮৬
সমাজের একটি সাধারণ প্রবণতা হলো, মা-বাবা ও গুরুজন শিশুকে নানা আশ্বাস ও প্রলোভন দেখান, অঙ্গীকার করেন যেন তারা গুরুজনের কথা শোনে। অথচ এসব অঙ্গীকার না কখনো পূরণ করা হয় এবং না কখনো তা পূরণের প্রয়োজনবোধ করা হয়। এমনকি তারা মনেও রাখেন না কবে কী অঙ্গীকার করেছিলেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এমন আশ্বাসকে মিথ্যা আখ্যায়িত করে তা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। কারণ এমন কাজে যেমন শিশুর মনে অঙ্গীকার রক্ষার গুরুত্ব হ্রাস পায়, তেমন তারা আস্থা ও শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে গুরুজনের ওপর থেকে। ফলে সাময়িক কিছু সুফল পাওয়া গেলেও শিশুর মানসিক বিকাশে তা স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো শিশুকে ডাকল, এদিকে এসো! (কিছু দেওয়ার জন্য) অতঃপর তা দিল না, তবে তা মিথ্যা।’ মুসনাদে আহমদ : ৯৮৩৬
একইভাবে নির্দোষ মনে করে মিথ্যা বলা হয় আড্ডা ও বৈঠকগুলোতে। হাস্যরসের জন্য দেওয়া হয় মিথ্যা উপমা। হাদিসে এমন মিথ্যার ব্যাপারেও কঠোর হুঁশিয়ারি এসেছে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অভিশাপ তাদের জন্য যারা কথা বলে এবং মানুষ হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে। তার জন্য অভিশাপ! তার জন্য অভিশাপ!’ সুনানে আবু দাউদ : ৪৯৯০
বর্ণিত হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা সানআনি (রহ.) বলেন, ‘এ হাদিস প্রমাণ করে, মানুষ হাসানোর জন্য মিথ্যা বলা হারাম। এটি বিশেষ ধারার নিষেধাজ্ঞা। শ্রোতার জন্যও তা শোনা হারাম যদি তারা বুঝতে পারে মিথ্যা বলা হচ্ছে। কেননা তা শোনা মিথ্যারই স্বীকৃতি, বরং তার দায়িত্ব হলো প্রতিবাদ করা এবং আড্ডা পরিহার করা।’
বাহয ইবনে হাকিম তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তার দাদা বলেছেন, ‘আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, সেই ব্যক্তির জন্য ধ্বংস নিশ্চিত যে মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা কথা বলে। তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধ্বংস।’ সুনানে তিরমিজি : ২৩১৫
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
muftianaet@gmail.com
ভয়েস/আআ